"এসএসএফ" ক্যাটাগরীর সকল আর্টিকেল
এসএসএফ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
মেজর সিনহা হত্যাঃ কুখ্যাত ওসি প্রদীপ-ইন্সপেক্টর লিয়াকতের মৃত্যুদন্ডে রায়; মেজর সিনহা; ওসি প্রদীপ; কুমার দাস; ইন্সপেক্টর লিয়াকত; আলী; টেকনাফ; বাহারছড়া; কক্সবাজার; কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ; সমুদ্র সৈকত; পুলিশ; সেনাবাহিনী; চেকপোস্ট; এসএসএফ; Major Sinha, OC Prodip, Inspector Liakot; SSF; Special Security Force; Army; Bangladesh Army; Bangladesh Police; Teknaf; Coxsbazar; Marine Drive; Bangladesh
মেজর সিনহা হত্যাঃ কুখ্যাত ওসি প্রদীপ-ইন্সপেক্টর লিয়াকতের মৃত্যুদন্ডে রায়

ভয়েস অব পটিয়া-ন্যাশনাল ডেস্কঃ মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ততার প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় হত্যাকারী কুখ্যাত ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাস ও ইন্সপেক্টর (বরখাস্ত) লিয়াকত আলীর মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। 

এ মামলার বাকি ১৩ আসামির মধ্যে ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সাতজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। 

আজ সোমবার (৩১ জানুয়ারি) বিকালে এ রায় ঘোষণা করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল। ৩০০ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণাকালে এজলাসে উপস্থিত ছিলো ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাস ও ইন্সপেক্টর (বরখাস্ত) লিয়াকত আলী সহ ১৫ আসামী। 
রায়ে বিচারক বলেন, ‘মেজর সিনহা হত্যার ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাসের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে গুলি করে আসামী লিয়াকত আলী। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সিনহাকে দেরিতে হাসপাতালে নেওয়া হয়।’  

রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলো- প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত ও বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব এবং টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মোঃ নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। 

খালাসপ্রাপ্তরা হলো- বরখাস্ত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এপিবিএনের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মোঃ রাজীব ও মোঃ আবদুল্লাহ। 

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ওসি প্রদীপ কুমার দাসের নির্দেশে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে, পরে ওসি প্রদীপ মেজর সিনহার গলায় পা দিয়ে হত্যাকান্ড ‍নিশ্চিত করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফে দুটি ও রামুতে একটি মামলা করে। ঘটনার পাঁচ দিন পর ০৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাস, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীসহ পুলিশের নয় সদস্যের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস। চারটি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। 

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও পিপি ফরিদুল আলম জানান, এ মামলায় আট দফায় ৮৩ সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা করা হয়। এরপর ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে আদালত রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। নির্মম ও আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ১৮ মাসের মাথায় রায় ঘোষণা হলো। বিচারিক কার্যক্রম শুরু করে মাত্র ৩৩ কার্যদিবসে শেষ হয়েছে মামলাটির পরবর্তী কাজ।
তিনি আরো বলেন, ‘ওসি প্রদীপ একজন নরপিশাচ। সে মাদক নির্মূলের নামে ক্রসফায়ার দিয়ে ২০৪ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। অপকর্ম জেনে ফেলায় মেজর সিনহাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে ওসি প্রদীপ, যা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করি প্রদীপ-লিয়াকতসহ জড়িত সব আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করবেন আদালত।’  

অন্যদিকে আসামীপক্ষের আইনজীবী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ নেতা এডভোকেট রানা দাসগুপ্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে এই ঘটনায় নির্দোষ দাবি করেছেন। 

রায়ের আগে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ফাঁসির দাবিতে টেকনাফ থানার আদালত চত্বরে মানববন্ধন করেন ওসি প্রদীপের গুম-খুনের শিকার ভুক্তোভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা। মানববন্ধনে তারা জানান, প্রদীপ কুমার দাস টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালে ক্রসফায়ারের নামে ১৪৫ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। এছাড়া নিরীহ লোকজনকে হয়রানি, ধর্ষণ ও অপহরণসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকারে হলেও কোন প্রতিকার পায়নি ভুক্তভোগীরা। তাই তারা মেজর সিনহা হত্যা মামলার রায়ের অপেক্ষায় ছিলেন। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, ওসি প্রদীপের হাতে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তাফা খান, ভুক্তভোগী হামজালাল ও ক্রসফায়ারে ছেলে হারানো হালিমা খাতুনসহ আরও অনেকে।

ক্রসফায়ারের নামে ওসি প্রদীপের নৃশংসতা

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার অন্যতম আসামী বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাস। টেকনাফ মডেল থানায় যোগদানের পর থেকে মাদক নির্মূলের আড়ালে সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার করা শুরু করে। অবৈধভাবে পেশিশক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। কিছু দিন যেতে না যেতেই তাকে টাকার নেশায় পেয়ে বসে। ইয়াবা ব্যবসায়ী ছাড়াও আর্থিকভাবে সচ্ছল নিরীহ পরিবারগুলোকে টার্গেট করে ওসি প্রদীপ। এর পর তাদের একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে, কথিত ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহিভূর্ত হত্যাকান্ড ঘটিয়ে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে রাতারাতি বিপুল অর্থবিত্তেরও মালিক বনে যায় কুখ্যাত ওসি প্রদীপ। ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে এসব লোমহর্ষক তথ্য উঠে এসেছে। 

কক্সবাজারের মহেশখালী থানা থেকে ২০ অক্টোবর ২০১৮ সালে ওসি হিসেবে টেকনাফ মডেল থানায় যোগ দেয় প্রদীপ। ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানায় যোগদানের পর তার নেতৃত্বে ও নির্দেশে শতাধিক বন্দুকযুদ্ধের নামে বহুলোককে হত্যা করা হয়। প্রদীপের অপরাধ প্রক্রিয়া ছিল কোনো ঘটনায় মাদক উদ্ধার হলে অথবা টার্গেট কোনো ব্যক্তিকে মাদক দিয়ে ফাঁসানো হলে (ফিটিং মামলা) প্রথমত আসামী বা ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এর পর স্থানীয় কিছু শ্রেণির লোকজনসহ তার নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের জন্য দেনদরবার করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ক্রসফায়ার না দেওয়ার শর্তে আদায় করা হতো। প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ আশানুরূপ বা চাহিদা অনুযায়ী হলে ভিকটিমকে ক্রসফায়ারে না দিয়ে মাদক উদ্ধার দেখিয়ে ওই ব্যক্তির বা আসামীর আত্মীয়স্বজনদের মামলার আসামী করা হতো। এ ক্ষেত্রে নারী, বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী কেউ তার আক্রোশ থেকে রেহাই পেত না। এমনকি নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নও করা হতো বলে তদন্তে জানা যায় এবং এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আদালতে মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। 
এরপর শুরু হতো তার অন্যরকম অবৈধ অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া। তার দায়ের করা মামলার কথিত এজাহারে বর্ণিত আসামীদের ক্রসফায়ারের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ আসামীর সৃজিত সম্পত্তি বেদখল করে এবং ভয় দেখিয়ে মামলা প্রতি লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করাই ছিল তার নেশা ও পেশা। এ কাজ করার জন্য ওসি প্রদীপ তার সমমনা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব পেটুয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলে। 

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, প্রদীপের এ ধরনের অপরাধকর্মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতেন না। যারা ন্যূনতম প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছেন, তারা এবং তাদের পরিবার ও নিকটাত্মীয়স্বজন তার অত্যাচার, নিপীড়নসহ মামলা-হামলার শিকার হতো। ওসি প্রদীপ টেকনাফ মডেল থানায় যোগদান করেই স্থানীয় কিছু দালাল শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে। মাদক নির্মূলের অজুহাতে ও নিজেকে সরকারের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক দেখানোর আড়ালে জনগণের তোয়াক্কা না করে, পুরো থানা এলাকায় এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করে, সমাজ ও জনপদে ত্রাস সৃষ্টি করে অপরাধের অভয়ারণ্য ও অপরাধকর্মের রামরাজত্ব কায়েম করে।
 
তার এ ধরনের অপরাধকর্মের প্রচার ও প্রসার রোধে আসামী প্রদীপ কুমার দাস ও তার দলবল স্থানীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোকজনকে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে মুখ বন্ধ করে রাখতো বলে জানা যায়। এতেও কাজ না হলে ভয়ভীতি-হুমকি প্রদর্শনসহ মামলায় জড়িয়ে কণ্ঠরোধ করা হতো। তার কুকর্মের বিষয়ে কেউ যাতে সংবাদ সংগ্রহ করতে এবং প্রচার করতে না পারে, সে বিষয়ে প্রদীপ কুমার দাস ছিলো সোচ্চার ও সতর্ক এবং এ ধরনের লোকজনের তথ্য সংগ্রহের জন্য সে তার থানায় এলাকাভিত্তিক সোর্স নিয়োগ করে রাখতো।